সোশ্যাল মিডিয়ার ফাঁদ: আপনার সন্তান কি সত্যিই বোকা?
Good Parenting
7/15/2025
সোশ্যাল মিডিয়ার ফাঁদ: আপনার সন্তান কি সত্যিই বোকা?
বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা ইউটিউব স্ক্রল করতে গিয়ে প্রায়শই আমরা এমন সব কন্টেন্ট দেখি যেখানে মায়েরা বিভিন্ন ব্লগে দেখাচ্ছেন তাদের শিশুরা অল্প বয়সেই গড়গড় করে ইংরেজি বলছে, অনর্গল ছড়া আবৃত্তি করছে, ফনিক্স উচ্চারণ করছে নিখুঁতভাবে, ভদ্র সোনামণির মত সব কথা শুনছে বা মুহূর্তেই খাবার খেয়ে "ইয়াম্মি" বলে প্লেট খালি করে ফেলছে।
এসব কন্টেন্ট দেখে আমাদের (অভিভাবকদের) মনে হয়, "আমার বাচ্চাটা কিছুই পারে না, আর আমি একজন ব্যর্থ অভিভাবক!"
এই ভাবনাগুলো কি সত্যিই সঠিক? আসুন, একটু গভীরভাবে চিন্তা করি।
🔷 সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের বাচ্চাদের দেখে যেসব ভাবনা আমাদের গ্রাস করে:
🔻"ওমুক আপু তো দেখলাম ৩ বছর বয়সেই বাচ্চাকে সব Alphabet/Numbers/বর্ণমালা শিখিয়ে ফেলেছেন!"
🔻 "আরে, ওমুকের বাচ্চার কী সুন্দর কবিতা আর ছড়া বলতে পারে!"
🔻 "ও মা! বাবুটা কী সুন্দর ফনিক্সের উচ্চারণ করতে পারে!"
🔻 "আরে ওই আপুর বাচ্চা তো যা খেতে দেয় তাই খেয়ে ফেলে!"
🔻 "উঁহ, বাবুটা যা বলে তা কি সুন্দর করে শোনে, একটুও বিরক্ত করে না!"
ফলস্বরূপ, আপনি ভাবছেন...
🌟 “আর আমার বাচ্চা তো মাথামোটা!”
🌟 “কিছুই পারে না, কথা শুনে না, খায় না, ঘুমায় না!”
🌟 “আমার জীবনটাই শেষ করে দিল!”
🌟 "এমন বাচ্চা না হলেই ভালো হত!" (আসতাগফিরুল্লাহ)
সম্মানিত অভিভাবক, একটু থামুন। ভাবুন।
এই ধরনের তুলনা এবং হতাশা হয়তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রাখবেন, সোশ্যাল মিডিয়ার এই জগৎটা বাস্তবতার সম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবি নয়।
প্রথমত, সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা যা দেখি তা জীবনের কেবল “সাজানো” অংশ। এই ধরনের কন্টেন্টে শুধুমাত্র সুখী, সহজ জীবন আর সফলতার অংশটুকুই দেখানো হয়। একটি বাচ্চার কোনো বিশেষ দক্ষতা অর্জনের পেছনে যে দীর্ঘ সংগ্রাম, ব্যর্থতা, ধৈর্যচ্যুতি বা দিনের পর দিন লেগে থাকার প্রচেষ্টা থাকে, সেগুলো কদাচিৎ দেখানো হয়।
একটি ছড়া শেখানোর জন্য হয়তো বাবা-মা দশবার চেষ্টা করেছেন, বাচ্চা হয়তো প্রথম ২০ বার ভুল করেছে বা খাবার খাওয়ানোর জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা যুদ্ধ করতে হয়েছে—এর "পিছনের গল্পগুলো" প্রায়শই আড়ালেই থাকে।
সোশ্যাল মিডিয়া একটি 'হাইলাইট রিল' (highlight reel), যা জীবনের সেরা অংশগুলোকেই তুলে ধরে, সম্পূর্ণ ছবিটা নয়। যখন আপনি দেখেন একটি শিশু হাসিমুখে সমস্ত খাবার খাচ্ছে, তখন হয়তো আপনি দেখতে পাচ্ছেন না যে এর আগে দশবার সে খাবার ছুঁড়ে ফেলেছে বা তাকে খাওয়ানোর জন্য কতটা পরিশ্রম করা হয়েছে।
🔖 প্রত্যেক শিশু স্বতন্ত্র, তুলনার প্রশ্নই ওঠে না:
দ্বিতীয়ত, সবার বাচ্চার বিকাশ একই রকম হবে এমনটা তো ঠিক নয়। প্রতিটি শিশুর শেখার গতি, আগ্রহ, ব্যক্তিত্ব এবং বিকাশের পর্যায় ভিন্ন হয়। কেউ হয়তো অল্প বয়সে কথা বলায় পারদর্শী হয়, তো কেউ হাঁটা বা দৌড়ানোতে। কারো হয়তো একাডেমিক বিষয়ে আগ্রহ বেশি, তো কারো খেলাধুলা বা বইপড়ায়।
আপনার সন্তান যদি তার বয়স অনুযায়ী পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারছে কিনা, সেদিকে নজর দিন। অন্য কোনো বাচ্চার সাথে আপনার সন্তানের তুলনা করাটা আপনার সন্তানের বিকাশের প্রতি অবিচার এবং তার আত্মবিশ্বাসের জন্য ক্ষতিকর।
৩. উদ্দেশ্য হোক 'ভালোবাসা' তৈরি করা:
তৃতীয়ত, আমাদের উদ্দেশ্য যেন এমন না হয় যে, বাচ্চাদের অল্প বয়সে অনেক কিছু শিখিয়েই ফেলব। বরং আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, সন্তানদের জ্ঞান আহরণের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করা, তাদের মধ্যে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করা।
জোর করে শেখালে বা অতিরিক্ত চাপে রাখলে হয়তো কিছু জিনিস শিখিয়ে ফেলা যাবে কিন্তু একসময় শিশুরা পড়াশোনার প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠবে, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের শিক্ষার আগ্রহকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
অপরদিকে যখন শিশুরা কিছু উপভোগ করে শেখে, তখন সেই শিক্ষা স্থায়ী হয় এবং তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্ঞান অর্জনের দিকে ধাবিত হয়।
আপনারা অনেকেই জানেন, ইমাম নববি রাহিমাহুল্লাহ-র ছোট বেলা থেকেই জ্ঞান অন্বেষণের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। তিনি ১০ বছর বয়সে খেলাধূলার চেয়েও বেশি কুরআন তিলাওয়াতকে প্রাধান্য দিতেন।
সহজ করে বললে, শিশু যেন পড়তে ভালোবাসে, জানতে চায় এটাই হবে তার জীবনের বড় অর্জন।
এই কারণে, মনোবিজ্ঞানী লেভ ভাইগটস্কি বলেছিলেন, শিশুরা নিজস্ব "জোন অফ প্রক্সিমাল ডেভেলপমেন্ট"-এ শেখে। জোর করে তাড়াহুড়ো করালে আত্মবিশ্বাস ক্ষুণ্ণ হয়।তখন সে শেখার আনন্দ পায় না বরং ভয়, হতাশা, আত্মবিশ্বাসহীনতা তৈরি হয়। 🌺 এক্ষেত্রে আমার কিছু পরামর্শ:
১. আপনার সন্তানকে সবচেয়ে বেশি আপনিই চিনেন:
মনে রাখবেন, আপনার সন্তানকে আপনিই সবচেয়ে বেশি চিনেন। তার কোন বয়সে কেমন শিক্ষা প্রয়োজন, তার আগ্রহ কিসে, তার মানসিক অবস্থা কেমন, সেই অনুযায়ী আপনি তাকে এগিয়ে নিন। অন্য কারো সন্তানকে দেখে নিজের সন্তানকে নিয়ে হতাশ হবেন না। আপনার সন্তানের নিজস্ব শক্তি ও দুর্বলতা আছে, সেগুলোকে বুঝুন এবং সেই অনুযায়ী সমর্থন দিন।
২. তুলনা নয়, সহোযোগিতা করুন:
সোশ্যাল মিডিয়ার 'পারফেক্ট' পরিবারগুলোকে দেখে নিজেদের সন্তানকে বিচার না করে, আপনার সন্তানের ছোট ছোট অর্জনগুলো উদযাপন করুন এবং সন্তানের জন্যে দু'আ ও আল্লাহ তা'আলার শুকরিয়া আদায় করুন। আপনার প্রশংসা তার আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তুলবে। আর শুকরিয়া করলে আল্লাহ তা'আলা আরো বেশি বারাকাহ দিবেন ইন শা আল্লাহ।
৩. বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা রাখুন:
শিশুদের কাছ থেকে তাদের বয়সের চেয়ে বেশি কিছু আশা করবেন না। তাদের বিকাশের পর্যায়গুলোকে বুঝুন এবং সেই অনুযায়ী বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা রাখুন। আপনার সন্তানের ইউনিক স্ট্রেন্থ খুঁজুন। হয়তো সে বাগান করতে পছন্দ করে, ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের প্রতি আগ্রহ (রোবট তৈরি) কিংবা অন্যদের সাহায্য করে। এগুলোও কিন্তু স্কিল।
৪. গুণগত সময় দিন:
স্ক্রিন টাইম কমান এবং আপনার সন্তানের সাথে গুণগত সময় কাটান। তাদের সাথে খেলুন, কথা বলুন, গল্প পড়ুন, সৃজনশীল কাজে উৎসাহিত করুন। এই ব্যক্তিগত সংযোগই তাদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশের জন্য সবচেয়ে জরুরি। গবেষণায় বলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় কাটানো প্যারেন্টদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে।
৫. প্রয়োজনে পেশাদার সাহায্য নিন:
সবশেষে, যদি মনে হয় আপনার সন্তানের বিকাশ অন্যদের তুলনায় সত্যিই অনেক ধীর বা কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে তার সমস্যা হচ্ছে যা আপনি নিজে সমাধান করতে পারছেন না, তাহলে একজন ভালো শিক্ষাবিদ বা শিশু বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিন। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ আপনার সন্তানের সঠিক বিকাশে সাহায্য করবে ইন শা আল্লাহ ।
সবশেষে বলব:
আমি আজ এক যুগেরও বেশী শিশুদের স্কুলের উস্তায। প্রতিদিনই শিশুদের একদম কাছ থেকে দেখছি। আপনারা হয়তো ১-২ জন সন্তান প্রতিপালন করে বড় করছেন, আমার সামনে শত শত ছোট্ট সোনামণি বড় হচ্ছে। মনে রাখবেন, আপনার সন্তান কোনো প্রতিযোগিতার মাধ্যম নয়, বরং আপনার সবচেয়ে মূল্যবান আমানত। তার প্রতিটি পদক্ষেপকে ভালোবাসা, ধৈর্য এবং বিচক্ষণতার সাথে দেখুন।
সোশ্যাল মিডিয়ার ঝলকানি দেখে আপনার সন্তানের প্রতি আপনার বিশ্বাস এবং ভালোবাসাকে হালকা হতে দেবেন না। আপনার সঠিক দিকনির্দেশনা এবং নিরন্তর সমর্থনই তাকে একজন আত্মবিশ্বাসী ও সক্ষম মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে।
🧠 মনে রাখবেন — “Every child is a different kind of flower, and all together make this world a beautiful garden.” 🌸 আপনার সন্তানও বিশেষ, ঠিক তার নিজস্ব গতিতেই।