🌿 সন্তানকে দ্বীন শেখাবেন নাকি কিয়ামতের লাঞ্ছনা ভোগ করবেন?
আচ্ছা, কখনও কি গভীর মনোযোগ দিয়ে সূরা ফুসসিলাতের এই আয়াতটি পড়ে দেখেছেন? একটু থমকে দাঁড়ানোর মতো কথা আছে এখানে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন,
وَقَالَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ رَبَّنَآ أَرِنَا ٱلَّذَيْنِ أَضَلَّانَا مِنَ ٱلْجِنِّ وَٱلْإِنسِ نَجْعَلْهُمَا تَحْتَ أَقْدَامِنَا لِيَكُونَا مِنَ ٱلْأَسْفَلِينَ
“সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীরা বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! যে সব জ্বিন ও মানুষ আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল তাদেরকে দেখিয়ে দাও, আমরা তাদেরকে পদদলিত করব, যাতে ওরা লাঞ্ছিত হয়।’ (সূরা ফুসসিলাত: ২৯)
ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন? জাহান্নামীরা আল্লাহ'র কাছে আবদার করবে, আর সেই আবদারটা কী?
যে সব জ্বিন ও মানুষ আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল, তাদের দেখিয়ে দিন!’
তাদেরকে দেখিয়ে দিন, যাতে তারা ক্রোধে, হতাশায় আর অপমানে সেই পথভ্রষ্টকারী মানুষ এবং শয়তানদেরকে পায়ের নিচে ফেলে পিষ্ট করতে পারে! তাদের লাঞ্ছনার কোনো সীমা যেন না থাকে।
পথভ্রষ্টকারী? কারা এরা?
আমাদের কমন সেন্স কী বলে? শয়তান/ ইবলিশ/জ্বিন এরা তো থাকবেই। কিন্তু আল্লাহ আয়াতে খুব স্পষ্ট করে বলছেন, "আল-জিন্নি ওয়াল ইনসি" জ্বিন এবং মানুষ। তার মানে কিয়ামতের দিন পথভ্রষ্টকারী হিসেবে মানুষেরাও দাঁড়াবে!
আমার প্রশ্নটা সেইসব মানুষ নিয়ে, যারা আমাদের আশেপাশে ছিল। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, সেইসব বাবা-মা নিয়ে, যারা কিনা তাদের সন্তানদেরই কিয়ামতের দিন লাঞ্ছনার কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এক. প্যারেন্টিং নয়, এ যেন "মিউজিক্যাল চাইল্ড কিলিং"
একটু বাস্তবতার দিকে তাকান। চারপাশে কী দেখছি আমরা?
সন্তান জন্ম নিয়েছে মুসলিম পরিবারে। কানে আযান দেওয়া হয়েছে, মুখে তুলে দেওয়া হয়েছে আল্লাহর সৃষ্টির অফুরন্ত নেয়ামত "মায়ের দুধ"। আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু এরপর?
এরপরের গল্পটা শুনলে আমার বুকটা ধক করে ওঠে।
সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানো হলো। ভালো কথা। কিন্তু এরপরই শুরু হলো সেই "আখিরাত ধ্বংসী রুটিন"। সকাল ৭টায় স্কুলের বাস, স্কুল শেষে সোজা নাচের ক্লাস, এরপর গিটার বাজানো শেখা, তারপর যদি একটু সময় থাকে তো আঁকাআঁকি।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও এক মিনিট দম ফেলার ফুসরত নেই। কারণ ব্যান্ড প্র্যাকটিস, ফোক ফেস্টিভ্যাল অথবা কোনো অমুসলিম কালচারাল প্রোগ্রামের মহড়া!
বাবা-মা দৌড়াচ্ছেন। খুব গর্ব করে বলছেন, “জানিস তো, আমার মেয়েটা দারুণ নাচে, সব প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়! আর ছেলেটা তো গিটার বাজিয়ে স্টেজ কাঁপিয়ে দেয়!”
কিন্তু তাকে কি জিজ্ঞাসা করেছেন, সলাতটা ঠিকমতো আদায় করা হচ্ছে তো? সে কি জানে, পর্দা কেন ফরজ? সে কি হালাল-হারামের বেসিক কনসেপ্টটা ক্লিয়ার করেছে? সে কি কুরআনটা অন্তত অর্থ বুঝে পড়ার চেষ্টা করে?
উত্তরটা বেশিরভাগ সময়ই হতাশার। দুনিয়ার জন্য দৌঁড়াতে গিয়ে বাবা-মা সন্তানদের সেই দ্বীনী শিক্ষা দিতে ভুলে গেছেন, যা ছাড়া কিয়ামতের দিন তার দাঁড়ানোরই কোনো জায়গা থাকবে না। এটা সন্তানকে কেবল পথভ্রষ্ট করা নয়, এটা হলো তাদের আখিরাতকে সজ্ঞানে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া।
দুই. ভুল লাইফস্টাইল: যখন সন্তানও হয়ে যায় 'শিরকের টুলস'
সন্তান যদি মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও বিজাতীয় বিশ্বাস আর সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে তার শেষ পরিণতি কী হবে?
সে খ্রিস্টানদের মতো ক্রিসমাসে মেতে উঠবে, হিন্দুদের মতো পূজার উৎসবে আনন্দ করবে আর পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির মতো জীবন যাপন করবে। তার কাছে আল্লাহ'র দেওয়া জীবন বিধান অর্থহীন মনে হবে। সে হয়ে উঠবে একজন নামকাওয়াস্তে মুসলমান, যার ঈমানী ভিত্তি নড়বড়ে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "যে ব্যক্তি কোনো কওমের সাদৃশ্য গ্রহণ করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।" (আবূ দাঊদ)।
একটু ভাবুন তো, আপনার সন্তান যখন বিজাতীয় স্টাইলে জীবন যাপন করে, হারামকে হালাল মনে করে এবং অশ্লীলতাকেই আধুনিকতা ভাবে, তখন এর দায় কার উপর বর্তাবে?
আপনারই উপর! কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনিই তাকে এই সংস্কৃতিতে ঢুকিয়েছেন। আপনিই তাকে সেই ফিতনার সরঞ্জাম হাতে তুলে দিয়েছেন। আপনিই তাকে শিখিয়েছেন, দ্বীন এখন ব্যাকডেটেড, ফিউচার হলো এই ফাস্ট লাইফে!
তিন. কিয়ামতের দিন যখন সন্তান আঙ্গুল তুলবে
এবার ফিরে যান সেই ফুসসিলাতের আয়াতে। যখন আপনার সেই আদরের সন্তান, যাকে আপনি গান, বাজনা আর নাচের ক্লাসে দৌঁড়িয়েছিলেন, সে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি দেখবে, তখন তার কী মনে হবে? সে তখন হয়তো আপনার দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে:
"হে আল্লাহ! আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল এই মানুষটি (আমার বাবা/মা)! ইনিই আমাকে দ্বীন শেখায়নি, উল্টো আমাকে হারাম পথে ঠেলে দিয়েছে। দুনিয়ার সামান্য সুখের জন্য ইনি আমার চিরস্থায়ী আখিরাত নষ্ট করে দিয়েছেন। আপনি এদেরকে দেখিয়ে দিন! আমরা এদেরকে পায়ের নিচে পিষ্ট করতে চাই, যাতে এরা সবচেয়ে লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত হয়!"
যে সন্তান দুনিয়ার জীবনে আপনার চোখের মণি ছিল, সেই সন্তানই কিয়ামতের দিন আপনার লাঞ্ছনার কারণ হবে! সে-ই হবে আপনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সাক্ষ্যদাতা। কারণ, আপনি তার সবচেয়ে বড় আমানত তার ঈমান ও চরিত্র রক্ষা করেননি, করতে শেখানও নি । আপনি ভুলে গেছেন আল্লাহ’র সতর্কবাণী: "হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা করো, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর..." (সূরা আত-তাহরীম: ৬)
যদি এই আয়াতটি, এই দৃশ্যটা আপনার অন্তরে একটুও কাঁপন তৈরি করে, তবে আজই থামুন। আজই আপনার সন্তানের হাতটা ধরে সেই পথের দিকে ফিরিয়ে আনুন, যে পথ জান্নাতের দিকে গেছে। দুনিয়ার দু'দিনের লাইফস্টাইলের চেয়ে আখিরাতের চিরস্থায়ী মুক্তি অনেক বেশি দামি।
সিদ্ধান্ত আপনার। হয় সন্তানের জন্য জান্নাতের রাস্তা তৈরির চেষ্টা করুন, নয়তো কিয়ামতের মাঠে তাদের হাতেই লাঞ্ছিত হওয়ার জন্য তৈরি থাকুন। কারণ, আল্লাহর বিচার খুবই স্পষ্ট, আর তা থেকে কারও পালানোর সুযোগ নেই।