🌟 ভালো সন্তান মানে আবেগহীন নয়
আমাদের সমাজে এখনো প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা রয়েছে: “ভালো সন্তান কাঁদে না”, “ছেলেদের আবেগ দেখানো যায় না”, "মেয়েদের সব কিছু মানিয়ে নিতে হয়", "বড় হয়ে নিজে থেকেই শিখে যাবে" ইত্যাদি। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি শিশুদের আবেগ প্রকাশকে দমন করে এবং জন্ম দেয় এক গভীর, অদৃশ্য মানসিক ক্ষতের।
শিশুকে শান্ত করার অর্থ তার অনুভূতি অস্বীকার করা নয়, বরং তার অনুভূতি চিনতে, বুঝতে ও সেগুলো কীভাবে সুস্থভাবে প্রকাশ করতে হয় তা শেখানোই হলো মানসিকভাবে সুস্থ ও পরিপূর্ণ মানুষ গড়ার মূল চাবিকাঠি।
একজন শিশুর সুষম বিকাশে শুধু খাবার, শিক্ষা কিংবা নিরাপত্তাই যথেষ্ট নয়। তাদের আবেগ-অনুভূতি বোঝা আর কঠিন সময়ে কীভাবে শান্ত থাকতে হয়, সেটা শেখানোও বাবা-মায়ের অনেক বড় দায়িত্ব। আজকের আলোচনায় আমি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব ইন শা আল্লাহ:
১. কেন শিশুকে তার কষ্ট বা আবেগ দমন করতে বলা উচিত নয়।
২. কীভাবে শিশুকে সঠিকভাবে তার আবেগ প্রকাশ ও সামলাতে শেখানো যায়।
🔻 প্রথমত, আবেগ দমন নয়, প্রকাশ ও প্রক্রিয়াকরণ
আমরা অনেক সময় চাই না আমাদের বাচ্চারা মন খারাপ করলে কাঁদবে বা রেগে গেলে চেঁচামেচি করবে। আমরা ভাবি, "চুপ থাকলেই তো ঝামেলা শেষ।" তাই আমরা বলি, "এই কাঁদবে না!", "এটা নিয়ে রাগ করতে হয় না!", "এসব নিয়ে চিন্তা করবে না!"
কিন্তু বাচ্চাদেরকে যখন আমরা তাদের মনের ভেতরের কষ্ট, রাগ বা ভয়টা লুকিয়ে রাখতে বলি, তখন কী হয় জানেন? তাদের ওই কষ্টগুলো মনের ভেতরেই জমতে শুরু করে। এতে তারা বাইরে থেকে হয়তো শান্ত দেখায়, কিন্তু ভেতর ভেতর তারা আরও বেশি অস্থির হয়ে ওঠে।
এইভাবে বারবার মনের কথা চেপে রাখতে গিয়ে তারা একসময় কেমন ''জড়'' বা "অনুভূতিহীন" হয়ে পড়ে। তখন নিজেরাই বুঝতে পারে না যে তারা আসলে কেমন অনুভব করছে। এর ফলে, তারা বড় হয়েও সহজে কারো কাছে মনের কথা বলতে পারে না, আর ছোটখাটো সমস্যাতেও খুব বেশি অস্থির হয়ে পড়ে।
🔻 দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব:
দীর্ঘমেয়াদে এই ধরনের শিশুরা বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগে। তারা হতাশা, উদ্বেগ, বিষন্নতা, আগ্রাসী আচরণ, রাগ নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং সম্পর্কের সমস্যায় পড়ে। অনেক সময় তারা ক্ষতিকর অভ্যাস যেমন অতিরিক্ত খাওয়া, গেমিং আসক্তি বা আক্রমণাত্মক আচরণের মাধ্যমে নিজেদের চাপা পড়া আবেগ প্রকাশ করার চেষ্টা করে।
আসল কথা হলো, ধৈর্য ধরা এবং শান্ত থাকাটা একটা শেখার বিষয়। বাচ্চারা এটা তখনই শিখতে পারবে যখন তারা তাদের রাগ, দুঃখ বা ভয়টাকে বুঝতে পারবে এবং সেটাকে সুস্থভাবে প্রকাশ করতে পারবে। জোর করে মুখের কথা বন্ধ করে দিলে বা কান্না থামিয়ে দিলে তারা আসলে মনের ভেতর থেকে শান্ত হয় না।
🔻 আমরা যে ভুল পদ্ধতি অনুসরণ করি:
ধরুন, আপনার মেয়ে তার সবচেয়ে প্রিয় খেলনা ভেঙে যাওয়ায় খুব কাঁদছে। আপনি যদি বলেন:
"আহ! কাঁদছো কেন? এটা তো শুধু একটা খেলনা। চুপ করো! এর জন্যে কাঁদতে হয় না!"
সে তখন হয়তো ধমক খেয়ে থেমে যাবে। কিন্তু তার দুঃখ, হতাশা বা চাওয়াটা ভেতরে জমে থাকবে। প্রতিনিয়ত এমন হলে সে হয়তো নিজেই তার আবেগ চেপে ফেলতে শিখে যাবে – এটিই "emotional numbness"বা "আবেগের অবসান"।
এভাবে ধীরে ধীরে যখন সে নিজের অনুভূতি ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারবে না — ভবিষ্যতে তখন তার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
🔻 আমাদের যা করণীয় ছিল:
একই পরিস্থিতিতে, আপনি শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারেন, "আমি জানি তোমার খুব মন খারাপ লাগছে, কারণ তোমার প্রিয় খেলনাটা ভেঙে গেছে। এটা খুবই দুঃখের বিষয়।" এরপর তাকে কাঁদতে দিন এবং তার অনুভূতি প্রকাশ করতে সাহায্য করুন। তারপর বলুন, "চলো, আমরা দেখি এটাকে ঠিক করা যায় কিনা অথবা আমরা নতুন কোনো খেলা খেলতে পারি।" এতে শিশুটি বুঝবে যে তার অনুভূতিকে মূল্য দেওয়া হচ্ছে এবং সে নিরাপদ পরিবেশে তার কষ্ট প্রকাশ করতে পারে।
🎯 সন্তানদের জীবনের চাপ ও পরীক্ষা মোকাবিলা শেখানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ
আসলে, প্রতিটি মানুষকেই জীবনে কমবেশি চাপ বা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এটা জীবনেরই একটা অংশ। তাই বাচ্চাদেরও এটা বোঝানো দরকার যে, জীবনে কিছু কঠিন সময় আসবেই।
যেমন: স্কুলের পরীক্ষার চাপ, বন্ধুদের সাথে ঝগড়া, কোনো খেলায় হেরে যাওয়া বা বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথে ছোটখাটো ঝগড়া – এগুলো সবই তাদের জন্য এক ধরনের চাপ।
শিশুদের জীবনের কঠিন বাস্তবতা থেকে আড়াল করে রাখা উচিত নয়। তাদের এই মৌলিক সত্যটি বোঝানো জরুরি যে, জীবনে বিভিন্ন ধরনের চাপ, সমস্যা এবং পরীক্ষা আসবেই। এগুলো জীবনেরই অংশ এবং প্রতিটি মানুষকেই এগুলো মোকাবিলা করতে হয়। এই উপলব্ধি শিশুদেরকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে তুলবে।
তবে, শুধু চাপ আসবে এটা জানা যথেষ্ট নয়; কীভাবে এই চাপগুলো মোকাবিলা করতে হবে, তার জন্য তাদের সঠিক 'সরঞ্জাম' (Tools) এবং 'পদ্ধতি' (Techniques) শেখানো অত্যন্ত জরুরি। এই 'সরঞ্জাম' এবং 'পদ্ধতি'গুলো হলো সুস্থ (coping mechanis) বা মোকাবিলা কৌশল।
যদি শিশুরা এগুলো না শেখে, তাহলে তারা চাপের মুখে এমন 'অস্বাস্থ্যকর' (unhealthy) এবং 'আত্মধ্বংসী' (damaging) কৌশল অবলম্বন করতে পারে, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করতে পারে।
🌟 খারাপ অভ্যাসগুলো কী হতে পারে?
• রাগ ও আগ্রাসন: রাগ হলে চিৎকার করা, জিনিসপত্র ভাঙা, মারামারি করা।
• প্রত্যাহার: সমস্যা থেকে পালিয়ে বেড়ানো, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, অন্যদের থেকে দূরে থাকা।
• অতিরিক্ত ঘুম বা অলসতা: চাপ এড়াতে অতিরিক্ত ঘুমানো বা সারাদিন শুয়ে থাকা।
• অতিরিক্ত খাওয়া/না খাওয়া: মানসিক চাপে খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম করা.
• মিথ্যা বলা বা দোষ চাপানো: নিজের ভুল ঢাকতে বা চাপ এড়াতে অন্যের উপর দোষ চাপানো।
• আসক্তি: বড় হলে (কিশোর বয়স থেকে) মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে মোবাইল, ইন্টারনেট, গেমিং বা আরও ক্ষতিকর আসক্তির দিকে ঝুঁকে পড়া।
• মাদকাসক্তি: (বড় হলে) মানসিক চাপ থেকে বাঁচতে সিগারেট বা অন্য খারাপ কিছুতে আসক্ত হয়ে যাওয়া।
🌟 আবেগ নিয়ন্ত্রণে শিশুদের সঠিক কৌশল (Tools and Techniques) শেখানোর কিছু উপায়:
• আবেগ চিহ্নিতকরণ ও প্রকাশ: শিশুদের তাদের অনুভূতিগুলো চিনতে এবং সেগুলোর নাম বলতে সাহায্য করুন (যেমন, "তোমার কি রাগ হচ্ছে?", "তুমি কি ভয় পাচ্ছ?"). তাদের বলুন যে, সব অনুভূতিই স্বাভাবিক এবং সেগুলো প্রকাশ করা ভালো, তবে সঠিক উপায়ে।
• কথা বলা: তাদের সাথে খোলামেলা কথা বলার একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করুন। তারা যখন মানসিক চাপে থাকবে, তখন যেন নির্ভয়ে আপনার সাথে কথা বলতে পারে। মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনুন।
• সমস্যা সমাধানের দক্ষতা: যখন তারা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন শুধু তাদের হয়ে সমাধান না করে, তাদের সাথে বসে সমাধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করুন। তাদের বলুন, "আমরা এটা কীভাবে ঠিক করতে পারি?" বা "তোমার কী মনে হয়, কী করলে ভালো হবে?"
• শারীরিক কার্যকলাপ: খেলাধুলা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো বা যেকোনো শারীরিক ব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে অত্যন্ত কার্যকরী। সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন, কোন না কোনভাবে এগুলোর সাথে আপনার সন্তানকে জড়িয়ে রাখতে। (এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো ইন শা আল্লাহ।
• শখ ও সৃজনশীলতা: ছবি আঁকা (প্রাণীর ছবি নয়), বাগান করা, লেখালেখি, কোডিং, ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরি ইত্যাদি – এই ধরনের সৃজনশীল ও সন্তানের পছন্দসই কাজে মন দিলে চাপ কমে। তাই এগুলোর ব্যাপারে তাদের সহোযোগিতা করতে হবে।
• গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম: সহজ কিছু শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম শেখাবেন, যা তারা অস্থির বা রাগান্বিত বোধ করলে করতে পারবে।
• ইসলামী শিক্ষা ও ধৈর্য: শিশুদের আল্লাহ তা'আলার উপর ভরসা করতে শেখাবেন, দু'আ করতে উৎসাহিত করবেন এবং ধৈর্য ও সবরের গুরুত্ব বোঝাবেন। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, নবি-রাসূল, সাহাবীদের জীবনের বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবিলার গল্প শোনাবেন ।
📚 বাস্তব জীবনের একটি উদাহরণ আপনাদের দেই, যা আপনাদের বুঝতে সাহায্য করবে।
আমার বন্ধুর ছয় বছরের মেয়ে তানিয়া। স্কুলে তার বান্ধবী তার সাথে খেলতে চায়নি বলে সে বাড়িতে এসে খুব কাঁদছে। তার বাবা তাকে বলল, "এত ছোট ব্যাপারে কাঁদছিস কেন? লজ্জা করে না? কেউ না খেললে বুঝি কাঁদতে হয়?"
বাস্তবে এমন আচরণ তানিয়ার জন্যে কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনবে না। বন্ধুর উচিত ছিল, সঠিক পদ্ধতিতে তানিয়ার অনুভূতিকে স্বীকার করা। তাকে বলা, "তোমার মন খুব খারাপ লাগছে, তাই না? যখন আমাদের প্রিয় বন্ধু আমাদের সাথে না খেলে তখন আমাদেরও দুঃখ লাগে। তুমি কী মনে করো কেন তোমার বান্ধবী তোমার সাথে খেলতে চায়নি?"
তারপর দুইজন মিলে এর কারণ বের করার চেষ্টা করা।হয়তো জানা যাবে যে তার বান্ধবী অসুস্থ ছিল বা অন্য কারণ ছিল। এভাবে তানিয়া শিখবে যে প্রতিটি পরিস্থিতির পেছনে কারণ থাকে এবং অনুমান করার পরিবর্তে কথা বলে সমাধান খোঁজা ভালো।
🌟 এমন আচরণের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব:
যে শিশুরা সুস্থ আবেগিক শিক্ষা পায়, তারা বড় হয়ে আরও সুখী এবং সফল জীবনযাপন করে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে, সম্পর্কগুলো গভীর এবং টেকসই হয়, এবং কর্মজীবনে তারা আরও কার্যকর হয়। তারা জানে কীভাবে চাপ সামলাতে হয়, দ্বন্দ্ব সমাধান করতে হয়, এবং অন্যদের সাথে সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, যে আবেগিক বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ব্যক্তিরা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আরও সফল হন, দলগত কাজে আরও অবদান রাখেন এবং জীবনে সামগ্রিকভাবে আরও সন্তুষ্ট থাকেন। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সফলতার জন্যই নয়, বরং একটি সুস্থ সমাজ গঠনের জন্যও অপরিহার্য।
📌 শেষ কথা:
সাহসী ও শক্তিশালী শিশু মানে সেই নয় যে সে কাঁদবে না বা রাগ করবে না, বরং সেই – যে তার আবেগ চিনতে পারবে ও সামাল দিতে জানবে।
তাই, পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উভয় স্তরেই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে আবেগ প্রকাশ দুর্বলতার লক্ষণ নয়, বরং মানবিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিটি শিশুর আবেগিক প্রয়োজন আলাদা, তাই আমাদের নমনীয় এবং ধৈর্যশীল হতে হবে।
এরই জন্যে আমাদের নিজেদেরও ক্রমাগত শিখতে হবে। যতই আমরা নিজেদের আবেগিক দক্ষতা বৃদ্ধি করব, ততই আমরা শিশুদের ভালো গাইড করতে পারব।
শেষ কথা হলো, শিশুদের আবেগ দমন করা নয়, বরং সেগুলো বুঝতে এবং সুস্থ উপায়ে প্রকাশ করতে শেখানোই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এটি তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ, সুখী এবং সফল জীবনের ভিত্তি স্থাপন করবে ইন শা আল্লাহ ।