“বাবার ছায়ায় একদিন: জীবনের বাস্তব পাঠ”
আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে কর্মজীবী বাবাদের জন্য পরিবারকে সময় দেওয়া এক বড় চ্যালেঞ্জ। দিনের বেশিরভাগ সময় অফিসে কাটানোর ফলে অনেক বাবাই সন্তানদের সাথে গুণগত সময় কাটাতে পারেন না। অন্যদিকে, সন্তানরাও স্কুল, কোচিং আর বাসার চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই সময়ের ব্যবধানে বাবা-সন্তানের মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কথা, তা প্রায়শই পিছিয়ে পড়ে। ফলে সন্তানদের কাছে বাবা হয়ে ওঠেন একজন নিয়মানুবর্তী বাবা, কখনো কখনো কঠোর ব্যক্তিত্ব, যিনি মূলত বকাঝকা করেন, আদেশ দেন এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
শুনতে অনেক অবাস্তব ও হাস্যকর শোনালেও, আমি কোনদিন যেকোন প্রতিষ্ঠানের মালিক বা নীতিনির্ধারক হলে, মাসে অন্তত একদিন বাবাদের সাথে সন্তানদের অফিসে আনা সহজ বাধ্যতামূলক করে দিতাম।
আর যে কেউ চাইলে মাঝে মাঝেই সন্তানদের অফিসে আনার সুযোগ করে দিতাম।
শর্ত: অবশ্যই কাজের ক্ষেত্রে যদি আমানতদারীতা ও ইনসাফ বজায় রাখতে পারে তাহলেই এই সুযোগ পাবে।
❓ কেন এই প্রস্তাব?
🔹যখন সন্তান নিজের চোখে দেখে তার বাবা কীভাবে দায়িত্ব পালন করেন, কতটা নিষ্ঠার সাথে কাজ করেন, তখন বাবা তার কাছে কেবল “বকাঝকা করা” বা “শুধু আদেশ দেওয়া” একজন মানুষ না থেকে এক বাস্তব, সংগ্রামী ও পরিশ্রমী আদর্শ পুরুষে রূপ নেয়। সেই মুহূর্তে সন্তান অনুভব করে—“বাবা শুধু আমার অভিভাবক নন, একজন যোদ্ধাও।”
🔹 সন্তান যখন বাবার অফিসে গিয়ে সহকর্মীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক, কাজের পরিবেশ, চ্যালেঞ্জ ও করণীয় দেখে, তখন তার নিজের ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে বাস্তব এক উপলব্ধি জন্মায়।
🔹 সন্তানরা যখন দেখবে তাদের বাবা কীভাবে দায়িত্বশীলতা, ইনসাফ ও আমানতদারিতার সাথে কাজ করেন, তখন তাদের মননে গেঁথে যায় “কাজ মানেই শুধু টাকা কামানো নয়, কাজ মানে দায়িত্ব, সততা ও আমানত”। এই শিক্ষা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
🔹 অফিসের পরিবেশ দেখে এবং বাবার কাজের ধরন বুঝে সন্তানরা তাদের ভবিষ্যৎ পেশা সম্পর্কে একটি বাস্তব ধারণা পাবে। তারা বুঝবে যে কর্মজীবনের জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, নিষ্ঠা এবং দায়িত্বশীলতা। এই অভিজ্ঞতা তাদের ক্যারিয়ার নির্বাচনে সাহায্য করবে এবং তাদের মানসিকভাবে কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করবে।
🔹সন্তান যদি বাবার কর্মস্থলে উপস্থিত থাকে, বাবা নিজের দায়িত্ব পালনে আরও সচেতন থাকেন—কারণ তাঁর সন্তান দেখছে। অন্যদিকে, সন্তানও দেখে বুঝে “বাবা কেন বাসায় এসে ক্লান্ত থাকেন, কখনো কখনো মেজাজ খারাপ থাকে”—তাতে তাদের মাঝে সহানুভূতি জন্মাবে।
🔹 এছাড়াও প্রতিদিন বাচ্চার পড়াশোনা, খাওয়া, ঘুম, খেলাধুলা—সবকিছু সামলাতে গিয়ে মায়েরা অনেক সময় একা হাঁপিয়ে ওঠেন। যদি মাঝে মাঝে সন্তান বাবার সাথে অফিসে যেতে পারে, তাহলে মা কিছুটা নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাবেন। এটা পারিবারিক ভারসাম্য গঠনে সহায়ক হতে পারে।
🔹 সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সন্তান যখন বাবার অফিস কিংবা কর্মস্থলে যাবে, দেখবে বাবা কতটা ব্যস্ত, ক্লান্ত আর দায়িত্বশীল—তখন তারা বুঝবে, “সুবহা-নাল্লাহ, শুধু আম্মুই না, আব্বুও তো অনেক কষ্ট করেন!” এই উপলব্ধি সন্তানকে বাবা-মা উভয়ের প্রতিই গভীরভাবে কৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাশীল করে তুলবে। তারা বুঝবে, পরিবারের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করতে বাবা-মা দুজনেই অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এই ধরনের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও কৃতজ্ঞতাবোধ একটি সুস্থ, সুখী ও শক্তিশালী পারিবারিক কাঠামো তৈরির জন্য অপরিহার্য।
তবে এক্ষেত্রে সম্ভাব্য কিছু চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে। যেমন: অফিসের কাজের পরিবেশে ব্যাঘাত, শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কর্মীদের একাগ্রতা বজায় রাখা।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন সুস্পষ্ট নীতিমালা এবং যথাযথ পরিকল্পনা। শিশুদের আগেভাগেই বুঝিয়ে বলা, তাদের তত্ত্বাবধানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা (বই, খেলনা, বিশেষ কক্ষ), অফিসের কলিগদের আগ থেকেই জানিয়ে রাখা, যেদিন কাজের চাপ কম আছে এমন দিন সিলেক্ট করা এবং কাজের সময় নির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করলে এই চ্যালেঞ্জ সমাধান তত কঠিন হবে না ইন শা আল্লাহ্।
এতটুকু আলোচনার পর বলছি, বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং হলেও অনেক বেশি কার্যকর। বিশ্বে অনেক বড় বড় কোম্পানি শিশুদের এভাবে কর্মস্থলে আনার অনুমতি দিয়ে থাকেন। ১৯৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম শুরু হয় (Take Our Daughters and Sons to Work Day)। তাদের লক্ষ্য ছিল: শিশুদের পেশাদার বিশ্বের সাথে পরিচয় করানো, ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণা দেওয়া। তবে আমাদের মুসলিম প্যারেন্টসদের লক্ষ্যে আরো সুদূরপ্রসারী হবে ইন শা আল্লাহ্।
🔸 শেষ কথা
শুধু অফিসে কাজ করলেই বাবার দায়িত্ব শেষ হয় না, পরিবারকে সময় দেওয়াও দায়িত্বের অংশ। একটি ছোট্ট উদ্যোগ—“বাবা ও সন্তানের মাঝে অফিস শেয়ারিং”—এই দূরত্ব কিছুটা হলেও কমাতে পারে। এতে সন্তান বাবা সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে ও শিখতে পারে এবং সম্পর্কের বাঁধন আরও মজবুত হবে। এছাড়াও পেশাগত দক্ষতা অর্জন হবে।
যদি আমাদের সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও পরিবার এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে, তাহলে হয়তো আমরা এক নতুন ধরণের বাবা-সন্তান সম্পর্ক গড়তে পারব—যেখানে শ্রদ্ধা, শিক্ষা ও ভালোবাসা মিলেমিশে এক অনন্য বন্ধন তৈরি করবে ইন শা আল্লাহ্।