🎬 টম অ্যান্ড জেরি: মজার নাকি ক্ষতিকর?
শৈশব মানেই নিস্পাপ আনন্দের সময়। কার্টুন এ বয়সের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনোদন মাধ্যম। তবে সব কার্টুন কি শিশুদের জন্য নিরাপদ? মুসলিম শিশুদের মানসিক ও চারিত্রিক গঠনে যেসব কার্টুন তারা দেখে, তার প্রভাব গভীরভাবে কাজ করে।
আমাদের শৈশবের একসময়ের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ‘Tom and Jerry’ কার্টুন মজার এবং হাস্যকর দৃশ্যের আড়ালে অ্যানিমেশনে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা মুসলিম পরিবারের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। একজন সচেতন মুসলিম অভিভাবক হিসেবে আমাদের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক।
বিশেষ করে ‘Tom and Jerry’ কার্টুনের কিছু দৃশ্য যেমন—চোখে ভালোবাসার প্রতীক ‘হৃদয় চিহ্ন’, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ, প্রেমঘটিত ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ, আঘাত ইত্যাদি শিশুদের কোমল মনে অজান্তেই ভুল বার্তা প্রোথিত করতে পারে।
🎯 বিষয়টি কেন গুরুত্বপূর্ন? চিহ্নিত সমস্যাসমূহঃ
১. রোমান্টিক এবং প্রেমের দৃশ্য
🌿 একটি শিশু যা দেখে, তা থেকেই সে শেখে। টম অ্যান্ড জেরিতে প্রায়শই দেখা যায় যে টম ও জেরি বিভিন্ন মহিলা ইঁদুর/বিড়ালের প্রতি আকর্ষিত হয়ে তাদের পিছনে ছুটে বেড়ায়। এই দৃশ্যগুলোতে প্রেম, রোমান্স এবং আকর্ষণের বিষয়গুলো শিশুদের কাছে স্বাভাবিক হিসেবে উপস্থাপিত হয়। অর্থ্যাৎ টম অ্যান্ড জেরি কার্টুনে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অতিরঞ্জিত ভালোবাসা, শারীরিক আকর্ষণ এবং প্রেমের উপস্থাপন শিশুদের মানসিক বিকাশে আগেভাগেই ‘রোমান্টিক’ আগ্রহ তৈরি করতে পারে।
২. অনুপযুক্ত শারীরিক অভিব্যক্তি (গোপন বার্তা)
🌿 প্রায়শই এই কার্টুনে কোনো দৃশ্যকে সরাসরি অশ্লীল না দেখালেও টম ও জেরির চোখে হার্ট আকৃতির প্রতীক, অতিরিক্ত উত্তেজনা এবং শারীরিক অভিব্যক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে “রোমান্স” ও “প্রেম” ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এগুলো শিশুদের মনে ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে। শিশুরা তখন এগুলোকে “নর্মাল” বলে মেনে নিতে পারে।
৩. হালাল-হারাম বোঝার ক্ষমতা বিকৃত হয়:
🌿 যে বয়সে শিশুদের শালীনতা, পর্দা, নৈতিকতা শেখার কথা, সে বয়সে যদি তারা এসব কনটেন্টে প্রেম-ভালোবাসার বারবার দৃশ্য দেখে, তাহলে তাদের মধ্যে হারাম ভালোবাসার প্রতি আগ্রহ বাড়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে, যা ইসলামি দৃষ্টিতে অত্যন্ত বিপদজনক।
৪. সম্পর্কের ভুল ধারণা
🌿পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে এসব কার্টুনে বিবাহপূর্ব সম্পর্ক, ফ্লার্টিং এবং অবাধ মেলামেশার বিষয়গুলো হাস্যকর রূপে উপস্থাপিত হয়। যা মোটেও মুসলিম শিশুদের জন্যে ঠিক নয়।
৫। হিংস্রতা স্বাভাবিকীকরণ:
🌿 বিভিন্ন পর্বে টম ও জেরির মধ্যে চলা মারধর, বিস্ফোরণ, আঘাত—এগুলোকে মজাদারভাবে দেখানো হয়। ফলে শিশুরা এগুলো অনুকরণ করতে পারে এবং হিংস্রতাকে সাধারণ বিষয় মনে করতে পারে।
৬. অবাস্তব ও বিভ্রান্তিকর বার্তা:
🌿এই কার্টুন সিরিজে বিভিন্ন সময় দেখানো হয় যে আঘাত পেয়েও কেউ মারা যায় না বা ক্ষতি হয় না। এটি শিশুদের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে যে বাস্তব জীবনেও আঘাত কিংবা ওদের মত হিংস্রতার কোনো পরিণতি নেই।
✅ ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি:
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে”। (বুখারী ও মুসলিম)
আল্লাহ তায়ালা বলেন: “হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন থেকে রক্ষা করো”। (সূরা তাহরীম: ৬)
ইসলামে শিশুদের মন-মানসিকতা (আদব-আখলাক) পবিত্র রাখার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের সামনে যা কিছু উপস্থাপন করা হয়, তা তাদের চরিত্র গঠনে প্রভাব ফেলে।
✅এসব কন্টেন্টের মাধ্যমে শিশুদের উপর ৩টি বড় নেতিবাচক প্রভাবঃ
১. নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়
🌿 কীভাবে ঘটে: শিশুরা যখন টম অ্যান্ড জেরিতে বিভিন্ন পর্বে দেখে যে প্রতারণা, মিথ্যা বলা বা অনৈতিক কাজগুলো “মজার” হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে, তখন তাদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হতে পারে যে এগুলো স্বাভাবিক বা গ্রহণযোগ্য। যেমনঃ
🔖 টম বিভিন্ন সময় মালিকের কাছে মিথ্যা বলে জেরিকে দোষারোপ করে
🔖প্রতারণার মাধ্যমে জেতার চেষ্টা করে
🔖অন্যকে ক্ষতি করে নিজের স্বার্থ হাসিল করে
⚠️ পরিণতি: শিশুরা মনে করতে শুরু করে যে এই আচরণগুলো স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য। ফলে তারা: সৎ-অসৎ কাজের পার্থক্য বুঝতে পারে না। পরিবার ও সমাজে এমন ভুল আচরণ শুরু করতে পারে।
২. যৌন অসচেতনতা
🌿 কীভাবে ঘটে: টম কিংবা জেরি যখন মহিলা বিড়াল/ইঁদুরদের দেখে চোখে হার্ট আসে বা রোমান্টিক আচরণ করে, তখন শিশুরা তাদের বয়সের তুলনায় অনুপযুক্ত বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠতে পারে ।
⚠️ প্রভাব:
🔖 ৬-৮ বছর বয়সী শিশুরা প্রেম-ভালোবাসার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে
🔖 তারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অস্বাভাবিক আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করতে পারে
🔖স্কুলে বা বাড়িতে “গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ড” সংস্কৃতি তৈরি হতে পারে
৩. আচরণগত পরিবর্তন (অনুকরণপ্রিয় প্রভাব)
শিশুদের অনুকরণের প্রবণতা:
🌿 শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই অনুকরণপ্রিয় হয়। তারা যা দেখে, তা-ই শিখে এবং অনুসরণ করার চেষ্টা করে।
📚 টম অ্যান্ড জেরি থেকে যে আচরণ শিখতে পারে:
⚠️ হিংসাত্মক আচরণ:
• একে অপরকে আঘাত করা
• প্রতিশোধের মনোভাব
• সহিংসতাকে “মজার” মনে করা
⚠️ প্রতারণামূলক আচরণ:
• চালাকি করে অন্যকে ফাঁদে ফেলা
• মিথ্যা বলে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা
• অন্যের ক্ষতি করে নিজের লাভ
⚠️ অসম্মানজনক আচরণ:
• নিয়ম-কানুন অমান্য করা
• দায়িত্বহীনতা ইত্যাদি
📌 মুসলিম অভিভাবকদের করণীয়:
১. সচেতন হোন:
আপনার সন্তান কী দেখছে, তা নিয়মিত খেয়াল রাখুন। বিনোদনের নামে কী বার্তা শিশুর মনে ঢুকছে, সেটি বোঝার চেষ্টা করুন।
২. বিকল্প দিন:
ইসলামিক গল্পের বই পড়া , খেলাধুলা, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, ছবি আঁকা (হারাম নয় এমন) , হস্তশিল্প ইত্যাদির ব্যবস্থা করুন। যা মজাও দেবে এবং শিক্ষাও দেবে।
৩. যৌথভাবে দেখুন:
যদি দেখতেই বাধ্যই হোন, তাহলে সন্তানদের যেকোন কনটেন্ট দেখার সময় পাশে বসে দেখুন এবং প্রয়োজনে কোন দৃশ্য বা বার্তা ভুল হলে কেন ভুল বা ঠিক নয় তা সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিন।
৪. স্ক্রীন টাইম সীমিত করুন:
প্রতিদিনের সময় বেঁধে দিন। দিনে নিদিষ্ট সময়ের বেশি ডিভাইস না দেখাই উত্তম। ( বয়স অনুযায়ী স্ক্রিন টাইম দিতে পারেন। যত কম দেয়া যাবে ততই ভালো। নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত না দেখিয়ে রাখতে পারলে তো সবচেয়ে ভালো)
৫. ইসলামিক শিক্ষা প্রদান
নিয়মিত কুরআন-হাদিসের শিক্ষা দিন। নৈতিক গল্প বলুন। দু’আ-দরুদ শিক্ষা দিন।
🏆 প্রযুক্তিগত সমাধান (নিচের দু’টি পয়েন্ট একদমই প্রয়োজনে)
১. প্যারেন্টাল কন্ট্রোল
• টিভি এবং ইন্টারনেটে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সেটিং ব্যবহার করুন
• এড ব্লকার ব্যবহার করুন। (বর্তমানে kahf Guard ব্যবহার সবচেয়ে নিরাপদ হবে ইন শা আল্লাহ্)
২. কন্টেন্ট ফিল্টারিং
• ইসলামিক অ্যাপস এবং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করুন
• হালাল কন্টেন্ট প্রোভাইডারদের সাবস্ক্রিপশন নিন
📚 দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা
১. চরিত্র গঠন
শিশুদের মধ্যে ইসলামিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করুন। আদর্শ মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করুন।
২. সামাজিক সচেতনতা
অন্যান্য মুসলিম পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখুন। সম্মিলিতভাবে শিশুদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করুন।
৩. শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম
ইসলামিক স্কুল বা মাদরাসার ব্যবস্থা করুন। নিয়মিত ইসলামিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করান।
✨ সবশেষে বলব,
টম অ্যান্ড জেরি বা অনুরূপ কার্টুনগুলো চমৎকারভাবে নির্মিত হলেও এর কিছু দৃশ্য কোমল শিশুদের জন্য উপযোগী নয়—বিশেষ করে মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুদের জন্য। তাই সময় এসেছে অভিভাবক হিসেবে শুধু খাবার বা পোশাক নয়, বরং ‘মানসিক খাবার’ হিসেবে তারা কী গ্রহণ করছে, তাও গভীরভাবে খেয়াল করার।
মনে রাখবেন, আজকের শিশুরাই আগামীর মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ। তাই তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
“আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকল শিশুকে নেককার মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলার তৌফিক দান করুন। আমীন”।
নোট: এই নির্দেশনা কোনো নির্দিষ্ট কার্টুন বা মিডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে নয়, বরং মুসলিম পরিবারের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। প্রতিটি পরিবার তাদের নিজস্ব বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেবেন।
✍️ জাহিদ হাসান
🗓️ ২২/০৫/২৫
জাযাকাল্লাহু খইর