“অভিভাবকত্বের ব্যর্থতা ও সমাজের বিপর্যয়”
শাইখ আলবানি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, "যদি সমস্ত মুসলিম তাদের নিজ নিজ পরিবারের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করত, তাহলে আজ আমরা আমাদের যুবক-যুবতীদের মাঝে যে ব্যাপক সমস্যা দেখতে পাচ্ছি—যেমন পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ, অমুসলিমদের অনুকরণ, পুরুষদের মধ্যে মেয়েলি আচরণ এবং নারীদের মধ্যে পুরুষালি আচরণ—এই ধরনের দুঃখজনক এবং প্রচলিত মন্দ কাজগুলো দেখতে পেতাম না।
ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর এই উক্তিতে মুসলিম সমাজের একটি মৌলিক দায়িত্বের প্রতি আলোকপাত করেছেন। আমরা প্রায়শই বাইরের বড় বড় সমস্যা নিয়ে কথা বলি( যেমন: সমাজের সমস্যা, রাষ্ট্রীয় সমস্যা) কিন্তু ভুলে যাই যে প্রতিটি বড় সমস্যা শুরু হয় আমাদের নিজেদের ঘর থেকে। শাইখের এই কথাটি একটি আয়নার মতো, যা আমাদের নিজেদের ভেতরের শূন্যতাকেই দেখিয়ে দেয়।
তিনি মূলত বুঝিয়েছেন, যদি প্রত্যেক মুসলিম তার পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হতো, তাহলে সমাজ এতটা অবক্ষয়ের শিকার হতো না। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের সঠিক শিক্ষা ও পরিচর্যা দিতাম, তাহলে আমাদের সমাজ এতটা কলুষিত হতো না।
🌿 পারিবারিক অবক্ষয়: শেকড়হীনতার প্রতিচ্ছবি
শাইখ আলবানি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মূল্যবান বক্তব্যের সূত্র ধরে আমরা আমাদের মুসলিম সমাজের গভীর সমস্যাগুলোর দিকে তাকাতে পারি। এই সমস্যাগুলো কেবল বাহ্যিক নয়, বরং আমাদের পারিবারিক ভিত্তি ও পরিচর্যার অভাবে সৃষ্ট।
১. পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ: আজ আমাদের যুবসমাজ পোশাক-আশাক, চালচলন এবং চিন্তাভাবনায় পশ্চিমা সংস্কৃতিকে অন্ধভাবে অনুসরণ করছে। এর মূল কারণ হলো, তারা ছোটবেলা থেকে নিজেদের পরিবারে একটি সুস্থ ইসলামিক পরিবেশ পায়নি। যখন একটি শিশু তার পরিবারে কোরআন তেলাওয়াত, সালাত আদায় বা ইসলামিক মূল্যবোধের চর্চা দেখে না, তখন সে তার পরিচয় খুঁজে ফেরে বাইরের ঝলমলে সংস্কৃতিতে। এই শূন্যতা তাকে শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং ভিনদেশি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট করে।
২. লিঙ্গের স্বাভাবিক ভূমিকা থেকে বিচ্যুতি: ইসলাম প্রতিটি লিঙ্গকে তার স্বভাব (ফিতরাত) অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ও সম্মানজনক ভূমিকা দিয়েছে। কিন্তু সমাজে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। অনেক সময় ছেলেসন্তানদের অতিরিক্ত নরম করে বড় করা হয় এবং তাদের কাঁধে কোনো দায়িত্বের ভার দেওয়া হয় না। এর ফলে, তারা পুরুষ হয়েও পুরুষের মতো দৃঢ়তা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে না।
অন্যদিকে, অনেক মেয়েকে ভুলভাবে 'স্বাধীনতার' নামে এমন পথে চালিত করা হয় যে তারা নিজেদের নারীসুলভ কোমলতা হারিয়ে ফেলে এবং পুরুষালি আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এই বিচ্যুতি তাদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয় এবং সমাজে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে।
এছাড়াও বর্তমান সময়ে ট্রা< ন্স- গন্ডার প্রভাব এমন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যা নারী-পুরুষের স্বভাবগত ফিতরাত ধ্বংস করে দিচ্ছে। যা স্পষ্টই কুফুরি কর্ম। এখানেও পরিবারের অসচেতনতা সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবেই দেখা যায়।
৩. মুসলিম পরিচয়ে গর্বের অভাব: অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের ইসলামিক নাম দিলেও তাদের জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা এবং আদর্শে পশ্চিমা রীতিনীতি গ্রহণ করে। এর ফলে, সন্তানরা নিজেদের মুসলিম পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করে না। তারা মনে করে, ইসলামিক মূল্যবোধগুলো আধুনিক জীবনের সাথে মানানসই নয়। এই মানসিকতা তাদেরকে মুসলিম উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতা তৈরি হয়। তারা নাস্তিক্যবাদ ও সেকুলারিজমকেই ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করে।
এছাড়াও প /র্ণ গ্রাফি, মাদক, হারাম রিলেশনশিপ, ভুল রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি তো আছেই। এই সমস্যাগুলো আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলছে। এর থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো আমাদের পারিবারিক জীবনে ইসলামের মূলনীতিগুলো ফিরিয়ে আনা। যখন প্রতিটি পরিবার ইসলামিক আদর্শে আলোকিত হবে, তখনই আমাদের সমাজ আবার তার নিজস্ব গৌরব ও পরিচয়ে ফিরে পাবে।
🔻 "পরিবারের প্রতি দায়িত্ব" বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
পরিবার হলো সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি, যেখানে একটি শিশু তার জীবনের প্রথম পাঠ গ্রহণ করে। পরিবারকে বলা যায় "মাদরাসাতুল উলা" বা প্রথম বিদ্যালয়।
আল্লাহ তাআ'লা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, "হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।" (সূরা তাহরীম: ৬)। এই আয়াতটি আমাদের শুধু নিজেদের রক্ষা করার কথাই বলে না, বরং আমাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতিও যে গভীর দায়িত্ব রয়েছে, তা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এখানে পারিবারিক "দায়িত্ব" বলতে কেবল আর্থিক চাহিদা পূরণ করা বোঝানো হয়নি। এটি একটি বহুমুখী ও গভীর দায়িত্ববোধকে নির্দেশ করে। এটি হলো একটি শিশুকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যাতে সে ইহকাল ও পরকালে সফল হতে পারে।
🌺 দায়িত্বের দিকগুলো ও সমাধানের পথ:
১. ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া:
পারিবারিক দায়িত্বের মূল ভিত্তি হলো দ্বীনি শিক্ষা। ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে তাওহীদ, রিসালাত এবং আখিরাতের মতো মৌলিক বিষয়গুলো শেখাতে হবে। যেমন, যখন একটি শিশু প্রশ্ন করে, আল্লাহ কে? তখন তাকে সহজ ভাষায় আল্লাহ তাআ'লার পরিচয় দেওয়া। সলাত, সাওম, হালাল-হারামের জ্ঞান দেওয়া এবং আল্লাহ তাআ'লার প্রতি ভালোবাসা ও ভয় তার হৃদয়ে গেঁথে দেওয়া। এগুলো মৌলিক কাজ।
২. নৈতিক ও চারিত্রিক গঠন:
শিশুদের মধ্যে সততা, আমানতদারি, ভদ্রতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করা খুব জরুরি। যখন কোনো শিশু সত্য কথা বলে, তখন তাকে প্রশংসা করা; যখন সে ছোটদের প্রতি স্নেহ দেখায়, তখন তাকে উৎসাহিত করা। এই ছোট ছোট অভ্যাসগুলোই তাদের চরিত্রকে দৃঢ় করবে ইনশাআল্লাহ ।
৩. আদর্শ রোল মডেল হওয়া:
পিতা-মাতা হলেন সন্তানের জন্য জীবন্ত উদাহরণ। আপনি আপনার সন্তানকে যে কাজ করতে নিষেধ করবেন, আপনাকেও সেই কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। যদি আপনি চান আপনার সন্তান মিথ্যা না বলুক, তবে আপনাকেও তার সামনে সর্বদা সত্য কথা বলতে হবে। আপনার আচরণই তার কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
৪. একটি পবিত্র পরিবেশ তৈরি করা:
বাড়িকে এমন একটি পরিবেশে পরিণত করা যেখানে আল্লাহর যিকির হয়, ভালো আলোচনা হয় এবং অনৈসলামিক বিনোদন থেকে সদস্যরা দূরে থাকে। যেমন, পরিবারের সবাই নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করা, ইসলামিক গল্প বলা বা ভালো বই পড়া ইত্যাদি। এটি তাদের মনে প্রশান্তি এনে দেয় এবং আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ককে দৃঢ় করে।
৫. সঙ্গ নির্বাচনে সাহায্য করা:
সন্তান কাদের সাথে মিশছে, কী করছে, তা যত্নের সাথে নজরদারি করা এবং ভালো বন্ধু নির্বাচনে তাদের সঠিক নির্দেশনা দিতে হবে। যখন আপনি সন্তানের বন্ধুদের সম্পর্কে জানতে চান, তখন তা যেন জেরা করার মতো মনে না হয়। বরং বন্ধুর মতো তাদের সাথে মিশে ভালো ও খারাপ সঙ্গের পার্থক্য বুঝিয়ে দিন।
৬. আবেগিক ও মানসিক সুরক্ষা দেওয়া:
সন্তানের সমস্যাগুলো মন দিয়ে শোনা এবং তাদেরকে পর্যাপ্ত সময় ও মানসিক সমর্থন দেওয়া। যখন সে কোনো সমস্যায় পড়ে, তখন তাকে তিরস্কার না করে বরং তাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আপনার ভালোবাসা এবং ধৈর্য তাকে মানসিক সুরক্ষা দিবে এবং আপনার প্রতি তার বিশ্বাস বাড়াবে।
৭. দু'আ ও আখিরাতের চিন্তা
পিতামাতার দায়িত্বের বড় অংশ হলো সন্তানের জন্য নিয়মিত দু'আ করা। কুরআনে নবীদের দু'আ আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত:
"হে আমার রব! আমাকে নামাজ কায়েমকারী করুন, আর আমার সন্তানদের থেকেও (একে নামাজ কায়েমকারী বানান)।" (সূরা ইবরাহীম: ৪০)
"হে আল্লাহ আমাদের সৎ সন্তান দান করুন ইত্যাদি দু'আগুলো নিয়মিত বেশি বেশি করতে হবে।
এই দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করলে আমাদের সন্তানরা কেবল দুনিয়াতেই সফল হবে না, বরং আখিরাতেও আল্লাহর কাছে সম্মানিত হবে। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপই সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য এক মূল্যবান বিনিয়োগ।
সবশেষে বলব,
শাইখ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ছোট্ট উক্তিটি আজকের যুগে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। পরিবারই হলো সমাজ পরিবর্তনের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। প্রতিটি মুসলিম পিতা-মাতার উচিত তাদের সন্তানদের প্রকৃত ইসলামী শিক্ষায় গড়ে তোলা, যাতে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি সুন্দর ও কল্যাণকর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।
যদি পরিবারে দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন হয়, তাহলে সমাজে অবক্ষয় হবে না। বরং সৎ, ঈমানদার, চারিত্রিকভাবে দৃঢ় মানুষ তৈরি হবে। আর দায়িত্ব অবহেলার পরিণতি তো আমরা সমাজে দেখতেই পাচ্ছি।
আল্লাহ তাআলা আমাদের পরিবারের প্রতি দায়িত্বগুলো সুন্দরভাবে পালন করার তাওফিক দিন এবং আমাদের সন্তানদেরকে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন। আমীন।